পাহাড়পুর ভ্রমণঃ সুখ-স্বাধীনতায় স্ববান্ধব একদিন

১৪ই আগস্ট, ২০১৫। বর্ষার শেষ বেলা। শ'খানেক সহপাঠী আর কয়েকজন শিক্ষক মিলে ঘুরে এলাম বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ নওগাঁর পাহাড়পুরে।

স্যার বলেছেন, ঠিক সাতটায় গাড়ি ছাড়বে। রাতে তারাতারি শু'লাম। কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে ভোর পাঁচটায় ডেকে দিতে বললাম। ঘুম ধরতে ধরতে ঘড়ির
কাটা বারো পেরুলো। ঘুম, ঘুম, ঘুম...উত্তেজনামিশ্রিত ঘুম! রাত তিনটের কিছু আগেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ঘুমোতে গেলাম। ঘুম নেই। ভিতরের তুমুল উত্তেজনা, আগমনী দিনের ভাবনা আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছে
না। অনেক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে চালাতে ভোর পাঁচটা বেজে গেলো, বন্ধুদের ফোনে আসতে শুরু করলো। আর ঘুমানো হলো না। ঘুমের পর্বটা অর্ধ-সমাপ্ত রেখেই উঠলাম। ভোরের নির্মল বাতাস শরীরে জড়িয়ে, শীতল জলে গোসল সেরে, হালকা পুরুষালি সাজুগুজু করলাম! বাইরে হঠাৎ ঝিরঝির বৃষ্টি; কিঞ্চিৎ আশঙ্কায় অন্তর্কোলাহল!

সাড়ে ছ'টার কিছুপর ক্যাম্পাসে গেলাম। বাসে উঠলাম। পিছনের ঝোলানো ব্যাগে
ডায়েরি, টি-শার্ট, ট্যাব, হেডফোন; কাঁধেচাপা গিটার; প্যান্টের পোকেট জুড়ে কলম, ফোন, আইডি কার্ড, টাকা, টিস্যু। পাশে বান্ধবী! সকাল আটটায় দু'টি বাস ক্যাম্পাস ছাড়লো।

দু'বাসেই বক্সে তুমুল গান চলছে, চলছে বাস। সকাল প্রায় দশটা। পেট চোঁ চোঁ শুরু করছে! স্যার সকালের খাবার...। কিছুক্ষণ পর হাতে হাতে প্যাকেট- রুটি, কলা, ডিম। সকালের নাস্তা হলো। বক্সে উচ্চস্বরে বিটযুক্ত গান, কয়েকজন বন্ধুর চলছে
কোমড় দোলা ডান্স, চলছে কৌতুক, গান, হাসি, চিৎকার। তুমি নীরব!

পথিমধ্যে গাড়ি থামলো জয়পুরহাট হাটে। দশ মিনিটের জন্য। কেউ পানি নিচ্ছে, কেউ বাদাম নিচ্ছে, কেউবা একটু হেটে আসছে। দু-একজন এ বাস থেকে ঐ বাসে পাল্টাপাল্টি করছে। তুমি নীরব!

গাড়ি ছাড়লো আবার। স্যার বললো, আর ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। আবার শুরু হলো আনন্দ- গল্প, গান, কবিতায়। শো শো করে গাড়ি চলছে। রাস্তার পাশে কখনো শহর, কখনো গ্রাম, কখনো সবুজ মাঠ, কখনো শুধুই গাছ আর দিগন্ত বিস্তৃত সুবিশাল মেঘভাঙা আকাশ। সময় গড়াচ্ছে, উত্তেজনা গাঢ় হচ্ছে। চলছে একের পর এক প্রতিভার বিস্ফারণ! কিছুদূর আগেই পাহারপুরের বিহারের সুউচ্চ অংশটা জানালা
দিয়ে চোখে পড়লো ; সবাই চিৎকার উঠলো। আর কিছুক্ষণ। সুখানুভূতি সমেত চাপা উত্তেজনা। আমি মাইক্রোফোন হাতে নিলাম। হেলাল হাফিজের 'ফেরীওয়ালা' কবিতাটি আবৃত্তি শুরু করলাম, 'কষ্ট নিবে কষ্ট। লাল কষ্ট, নীল কষ্ট ... '। কবিতা শেষে সবার সঙ্গে তুমিও করতালি দিলে চিৎকার করে! অনেকে কষ্টের আবদার করলো। এতো সুখের মাঝে কষ্ট কি আর চাইলেই পাওয়া যায়?

গন্তব্যে গাড়ি থেমেছ দুপুর একটার দিকে। সবাই নেমে পড়লো। একটু পরেই বিহারের সীমানায় প্রবেশ করলাম আমরা। প্রায় চার-পাঁচশ বছর আগের এক বিশাল এক বৌদ্ধ বিহার। শুরুতেই সু-সজ্জিত বাগান। বাহারি ফুল-গাছ-লতা-পাতা। তারপর বিশাল
এলাকাজুড়ে উঁচু-নিচু পুরাকীর্তি। লাল লাল পুরোনো ইট, লাল লাল মাটি। সবাই সবার ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত; ব্যস্ত আমিও। ছবির পোজে পর্যাপ্ত বৈচিত্র্য। একার ছবি, জোড়া ছবি, সদলবলে ছবি, বন্ধুর পাশে ছবি, বান্ধবীর চোখে চোখ রেখে ছবি, সুবিধাজনক স্থানে ছবি, আশঙ্কাজনক স্থানে ছবি, অতঃপর শুধুই ছবি।

এরপর ঘুরে বেড়ানো হলো, গান হলো, নূপুরশূন্য পায়ে নৃত্য হলো। বসেবসে গল্প হলো, কয়েকজোড়া জুটির নীরবে প্রেম হলো, পুরোনো জুটির আড়ালে চুম্বনও
হলো হয়তো! তারপর?

ওদিকে রান্না শেষ। পোলাও, খাসি ও অন্যান্য। এই সাধারণ খাবারগুলোকে অসাধারণ ভেবে তিন প্লেট খেয়ে নিলাম। তুমি দেখে নীরবে হাসলে! সবার
ক্ষেত্রেও হয়তো তা-ই হলো। খাবার শেষে গরম কোক! হোক গরম তাতে কি? নিমিষেই সাবার!

সবশেষে পড়ন্ত বিকেলে গুরুজনদের কথা হলো। বিশ টাকার কুপুনের ড্র হলো। মূল পুরস্কার বিশটি, স্যাররা, বন্ধুরা পেলো। আমি কখনো এগুলোতে পুরস্কার পাই নি, যথারীতি তা-ই হলো। শান্ত্বনা পুরস্কার কলম নিয়েই শান্ত থাকলাম। তোমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে; তুমি হয়তো নীরবে ভাগ্যকে দুষলে!

গন্তব্যের গান সাঙ্গ করে সবাই গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি উল্টো যাত্রা শুরু করলো। সারাদিনের প্রাপ্ত আত্মতৃপ্তি প্রস্থানকালে কাজে দিলো। গাড়িতে শুরু থেকেই শুরু হলো, তুমুল লাফাঙ্গা ডান্স! ফেরার পুরো সময়টা জুড়ে চললো হইহুল্লোড়, নাচ আর গান। স্যার গাইলো, সবাই গাইলো। স্যার কোমর দুলালো, সবাই কোমর দুলালো। আমার সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে জুবুথুবু। ফেরার পুরোটা পথে তুমি সরব ছিলে, তুমিও গেয়েছিলে!

রাত সাড়ে ন'টার দিকে ক্যাম্পাসে গাড়ি থামলো। সব মায়া ক্ষণিকের তরে ছিন্ন করে
নিঃশব্দে মেসে ফিরলাম। গোসল করে শান্ত হলাম। রাতে খাবার দেই নি, কলা-বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়লাম। দু'চোখে ঘুম নামার আগে মনে হলো, এমন আনন্দপূর্ণ দিনে কাঁধেচাপা গিটারের সুরে গাওয়া গান বন্ধুদের আবদার ছিলো, সে আবদার অপূর্ণই থাকবে হয়তো আজীবন। আর আমার অপ্রাপ্তির তালিকায় ছিলো তোমার প্রেম। সেও কি অধরায় রবে আজীবন...?

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত