টিকটিকি ও আমি
রাত প্রায় দুটা বাজে। চোখে ঘুম নেই। গরমে ছটফট্ করছি। বাহিরে পেঁচাটা ডেকেই চলছে। রুমে টিউবলাইট টা জ্বালানোই আছে। ফ্যানটা শো শো ঘুরছে, কিন্তু বাতাস গায়ে লাগছে না। লাইটের নিচে দেয়ালের সাথে স্থির হয়ে লেগে আছে লেজ কাটা টিকটিকিটা! আজ শোয়ার পূর্বে আমার হাতেই ওর লেজটা কেটে যায়; বিছানা ঝাড়া ঝাড়ুর
আঘাতে। অনিচ্ছায় নয়; ইচ্ছায়!
ছোটবেলায় একবার ট্রেন ভ্রমণ করেছিলাম। আজ আবার শখ হল। যেই কথা- সেই কাজ! ট্রেনে উঠলাম। জানি না কোথায় যাচ্ছি; গন্তব্যহীন যাত্রা!
ট্রেনের মাঝের একটি বগিতে উঠেছি। ট্রেন চলছে ঝকঝক্ করে। চলছে তো চলছেই। একটু পর ট্রেন থামলো। কিছুক্ষণ পর আবার চলতে শুরু করলো। বুঝতে পারলাম যাত্রী উঠা-নামা করার জন্য স্টেশনে থেমেছিল।
একটি মেয়ে এসে আমার পাশে বসলো। অবাক হলাম! এত সিট খালি থাকতে আমার পাশে কেন বসলো? মেয়েটি দেখতে মারাত্মক ধরনের সুন্দর! মনেমনে ভাবলাম- ভালোই হল; একটা ভালো ভ্রমণ সঙ্গী পেলাম! কিন্তু খুব সংকোচ বোধ করতে লাগলাম। কী আর করার আছে? নীরবে একটি ভদ্র বালকের মত বসে থাকলাম; যদিও আমি বালক হিসেবে মোটেই ভদ্র নই! অভদ্র ছেলেদের আশেপাশে মেয়ে থাকলে বারবার তাকায়- সরাসরি কিংবা বাঁকাচোখে। আর হৃৎপিন্ডটা চলে দ্বিগুণ হারে। যদিও আমি শুধু একবার তাকিয়ে আর তাকায় নি, কিন্তু হৃৎপিন্ডটা চলছে খুব দ্রুত। অর্থাৎ আমি অর্ধভদ্র!
কিছুক্ষণ পর। মেয়েটি আমার দিকে সরাসরি তাকালো। অতঃপর একটু মুচকি হাসলো। মেয়েটি আমাকে বললো, "তোমার নাম কী?"
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে ধিরেধিরে বললাম, "আপু, আমাকে বলছেন?"
-হ্যাঁ, তোমাকে। তুমি বললাম, তাই অবাক হচ্ছো নাকি?
আমি উত্তরে "না" বলে একটু হাসলাম। যদিও আমার অবাক হওয়ার কারণ ওটাই!
-তুমি না বল আর যাই বল, এটা সত্যি! যাহোক, কেন তুমি বললাম কারণটা পরে বলবো। এখন বল তোমার নাম কী?
-সুপ্ত। আপু, আপনার নামটা জানতে পারি?
-আমি উর্মি। তোমার নামটা কে রেখেছে?
-জানি না। হয়তো বাবা কিংবা মা।
-নামটার সঙ্গে তোমার চেহারার কিন্তু মিল আছে!
-মানে?
-মানে তোমার চেহারায় এক ধরনের সুপ্ত ভাব অর্থাৎ নীরব ভাব আছে। কিন্তু মনের সঙ্গে মিল নেই। তোমার মনটা কিন্তু সুপ্ত নয়- চঞ্চল!
আমি অবাক হলাম! কীভাবে সম্ভব একজনের সঙ্গে মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলে তার সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া? এ তো দেখছি মহামনোবিজ্ঞানী!
-আপু, কীভাবে বুঝলেন?
-বুঝতে পারি। কিন্তু আমাকে আপু বলছো কেন? বললাম তো আমি উর্মি।
-তাহলে কী বলবো? উর্মি আপু?
-না। শুধু উর্মি।
-কেন?
-এর উত্তর পরে দিচ্ছি। কিন্তু মিললো নাতো।
-কী মিললো না?
-তোমার আর আমার নাম দুটো। সুপ্ত-উর্মি। উর্মি তো কভু সুপ্ত হয় না; উর্মির চঞ্চলতা থাকে। সমুদ্র উর্মির চঞ্চলতাকে তুমি সুপ্ত বানিয়ে দিলে!
-কী বলছেন এসব? আপনার নামের..
-আবার আপনি? বল তুমি।
-ও আচ্ছা। তোমার নামের সাথে আমার নাম মিলতেই হবে?
-না। নাম মিলতে হবে না; মন মিলছে তো- এতেই হবে।
-আপনি- সরি, তুমি কী বললে আমি ঠিক বুঝলাম না।
-বুঝতে পারতে, যদি আমার প্রেমে না পড়তে!
-কি বললে আমি তোমার প্রেমে পড়েছি? আপনার সঙ্গে কথা বলাই ঠিক না। চুপ করেন; আপনার তো দেখছি মাথা গেছে।
আমি কিছুটা রেগে গেলাম।
মেয়েটি গম্ভীর স্বরে বললো, "আবার কিন্তু আমাকে আপনি বলেছ। চুপ করার সময় হলে চুপ করবো; কার মাথা গেছে তখন বুঝবা! তবে হ্যাঁ, তুমি আমাকে ভালোবাস- এটা যেমন সত্য; আমি তোমাকে বাসি এটাও সত্য।"
আমি নীরবে মাথা নিচু করে সুবোধ বালকের মত বসে আছি।
কিছুক্ষণ পর বললাম, "আপনি আমাকে ভালোবাসেন আর যাই বাসেন, তা আপনার ব্যপার। আর.."
-চুপ কর বলছি। যতক্ষণ আমাকে "তুমি" বলবা না, ততক্ষণ তোমার কোন কথা শুনতে রাজি নই আমি।
-ঠিক আছে তুমি বলছি। কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসতে যাব কেন?
-আমি যে সুন্দর!
আমি মাথাটা একটু নিচু করে লাজুক স্বরে বললাম, "তুমি আসলেই খুব সুন্দর! সত্যি তুমি আমাকে ভালোবাস?"
-হ্যাঁ।
-আমিও।
-এটা বলার কোন প্রয়োজন নেই; আমি জানি। আর আমাকে "তুমি" বলতে বলেছি এ কারণেই!
-কিন্তু তুমি কীভাবে মানুষের মন সম্পর্কে জানতে পারো?
-তা নিজেও জানি না আমি। তুমি কাল একটা টিকটিকির লেজ কেটে দিয়েছিলে, তাই না?
-হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে জানলে তুমি?
-বললামতো আমি নিজেও জানি না।
আরোও অনেক গল্প হল আমাদের দুজনার। একসময় মেয়েটি আমাকে বললো, "চলো দড়জার নিকটে দাঁড়িয়ে কথা বলি।"
-কেন? জানালার কাছেই তো ভালো লাগছে।
-যাবাই তো, এত কথা বলো কেন? চলো তো...
-ঠিক আছে চলো...
দুজনে দড়জার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝকঝক্ করে ট্রেন চলছে। দুজনে গল্প করছি। পাশ দিয়ে সবুজের সমারহ। আহ্, কী সুন্দর দৃশ্য! হঠাৎ মেয়েটি আমাকে ধাক্কা দিলো! আর অমনি আমি ট্রেন থেকে পড়ে গেলাম! আমার বাম পা টা চাকার নিচে পড়ে কেটে গেলো! কিন্তু একি, আমাকে ধাক্কা দিয়ে সে নিজেও ট্রেন থেকে লাফ দিলো! ওর কোন ক্ষতি হল না। আমার পায়ের কাটা জায়গায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
মেয়েটি আমাকে নরম গলায় বললো, "সত্যি আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেই নি সুপ্ত; দুষ্টুমি করতে এ কী হলো!"
-সব সময় দুষ্টুমি? আসলে তোমার মাথা খারাপ।
মেয়েটি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। অতঃপর চিকিৎসা করিয়ে আমার বাসায় নিয়ে এলো। আমার বাম পা টা নেই; আমি এখন হুইল চেয়ারে বসে চলাফেরা করি। আমি আমার মাকে বললাম, "উর্মি না থাকলে আমি মরেই যেতাম।"
পরে উর্মি আমাকে বললো, "মাকে মিথ্যে বললা কেন?"
-মা যদি জানতো তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়েছিলে, তাহলে মা তোমাকে বাসা থেকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিত।
-তাড়িয়ে দিলে কী হতো? আমি তোমাকে ধাক্কা দিয়েছিলাম ট্রেন থেকে। আর এতো সামান্য বাসা থেকে গলাধাক্কা, ব্যপার না।
-কিন্তু...
-কিন্তু কী?
-আমি তোমাকে যে খুব ভালোবাসি।
-এবার বুঝেছ কার মাথা গেছে?
এরপর মেয়েটি মাকে ডেকে বললো, "আমি সুপ্তকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়েছিলাম।"
তারপর যা ঘটার তাই ঘটলো। মা মেয়েটিকে বাসা থেকে বের করে দিলো! বাম পায়ের কাটা জায়গাটার মত আমার বুকের কোণেও প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হলো। পা আর বুকের যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে উঠলাম!
দেখি টিউবলাইটের নিচে টিকটিকিটা এখনো আছে! ওটার লেজ গজিয়েছে! আমার বাম পায়ের দিকে তাকালাম; পা টা ঠিকই আছে। বুঝতে পারলাম স্বপ্ন' দেখছিলাম। স্বপ্নটা এখন আর নেই; পায়ের সেই তীব্র যন্ত্রণাটাও নেই। নেই সেই বিস্ময় বালিকা "উর্মি"! আছে শুধু টিউবলাইটের নিচের সেই টিকটিকি, রাতের বিছানার সেই আমি আর বুকের কোণে আত্মশুদ্ধির আলতো অনুভূতিটুক।#
★★★'টিকিটিকি ও আমি' ছোটগল্প টি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ 'পথ' এ প্রথম প্রকাশিত হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন